হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, ইসলামী ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত নাম বেলাল। পিতা রাবাহ, মাতা হামামাহ। তিনি হাবশি ক্রীতদাস ছিলেন। তবে জন্ম মক্কায়।
বনু জুরহাম তাঁর মনিব ছিল। হাবশি হওয়ায় গায়ের রং যদিও কালো ছিল, কিন্তু অন্তর ছিল ধবধবে সাদা, স্বচ্ছ-সফেদ। তাতে ছিল না কোনো রাশ-দাগ, পাপ-পঙ্কিলতা। নবী (সা.) সত্য দ্বিনের আওয়াজ তুললে যে কয়েকজন ঈমানের বরকত লাভে ধন্য হন, তাঁদের মধ্যে যে সাতজন প্রকাশ্যে ঈমানের ঘোষণা দেন বেলাল (রা.) তাঁদের অন্যতম।
[আসহাবে রাসুলের জীবন কথা : ১/১১২]
ঈমান আনার কারণে বেলাল (রা.)-এর উপর নেমে আসে অবর্ণনীয় অত্যাচার। প্রতিদিন প্রয়োগ করা হতো নিত্যনতুন শাস্তি। মরুর জলন্ত প্রায় বালু, পাথর এবং জলন্ত অঙ্গারে শুইয়ে বুকে চেপে দেওয়া হতো শক্ত পাথর। কখনো ছাগলের মতো গলায় রশি পেঁচিয়ে টেনেহিঁচড়ে ঘুরানো হতো মক্কার অলিগলিতে।
শক্ত পাথরের আঘাত ও খোঁচায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে যেতে শরীর। এত কষ্ট সহ্য করেছেন, তবু ঈমান ত্যাগ করেননি। তাঁর মুখ থেকে নিঃসৃত হতো সুমধুর শব্দ আহাদ, আহাদ। আল্লাহ এক, আল্লাহ এক।
উমাইয়্যা বিন খালফ তাঁকে শাস্তি দিতে নিত্যনতুন শাস্তির কলাকৌশল বের করত।
কখনো দুর্গন্ধময় গরুর চামড়ায় পেঁচিয়ে, আবার কখনো লোহার পোশাক পরিয়ে দুপুরের অগ্নি বর্ষিত রোদে বসিয়ে দিয়ে বলত, তোমার আল্লাহ লাত, উজ্জা। কিন্তু বেলাল (রা.) বলতেন, আহাদ, আহাদ। কাফিররা বলত, বেলাল! আমরা যে শব্দগুলো বলি সেগুলোই বলো—আমরা তোমাকে ছেড়ে দেব। বেলাল (রা.) জবাব দিতেন, তোমাদের শব্দগুলো আমি উচ্চারণ করতে পারি না।
পরিশেষে বিপুল অর্থের বিনিময়ে বেলাল (রা.)-কে আজাদ করার ব্যবস্থা করেন সাহাবীগণ (রা.)।
মদিনায় রাসুলের মসজিদ নির্মাণ হলে বেলাল (রা.)-কে প্রথম আজানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাঁর সুমধুর আজান শুনে মদিনার ছোট-বড়, যুবক-বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ কেউ ঘরে থাকতে পারত না। সবাই সমবেত হতো মসজিদে।
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ইন্তেকালের পরে তিনি মনস্থ করেছিলেন, যে নবীর জন্য আজান দিতাম তিনি যেহেতু নেই, তাই আর আজান দেব না।
১৬ হিজরিতে ওমর (রা.) বাইতুল মুকাদ্দাস সফরে তাঁকে আজান দেওয়ার অনুরোধ করলে, তিনি আজান দেন। উপস্থিত সবাই বাকরুদ্ধ হয়ে যান। ওমর (রা.)সহ অন্য সাহাবিরা ডুকরে কাঁদেন। বেলালের মরমি আজান আর কারো দ্বারা সম্ভব হয়নি, হবেও না।
নবীপ্রেমিক এই সাহাবি নবীর বিরহ সইতে না পেরে সিরিয়ায় স্থায়ী বসবাস শুরু করেন। দীর্ঘদিন পরে একদিন নবীজিকে স্বপ্নে দেখেন। নবীজি (রা.) তাঁকে বলছেন, ‘বেলাল! এমন নিরস জীবন আর কতকাল? আমার জিয়ারতের সময় কি এখনো হয়নি?’ নবী প্রেমের ক্ষত তাজা হলে তিনি মদিনায় ফিরে আসেন। নবীর রওজার সামনে এলে জবাই করা মোরগের মতো ছটফট করতে থাকেন।
মক্কা বিজয়ের পর রাসুল (সা.) কাবায় প্রবেশ করলে বেলাল (রা.) তাঁর সঙ্গেই ছিলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বেলালকে কাবার ছাদে উঠে আজান দিতে বললে, তিনি আজান দেন। মূর্তিমুক্ত কাবায় প্রথম আজান দেওয়ার ভাগ্য অর্জন করেন বেলাল (রা.) একমাত্র ঈমানের কারণে।
[ইবনে হিব্বান, হাদিস: ৩২০৪]
বেলাল (রা.) বদরের যুদ্ধে অংশ নেন। সেই হিসাবে তিনি বদরের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবি। রাসুল (সা.) বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা বদরি সাহাবিদের ক্ষমা করেছেন।
[তারিখে দেমাস্ক: ৯/৮১]
একদিন নবী (সা.) তাঁকে বলেন, বেলাল! কিসের বদৌলতে তুমি আমার আগেই জান্নাতে চলে গেলে। গতরাতে আমি জান্নাতে প্রবেশ করে তোমার পায়ের খসখস আওয়াজ শুনতে পেলাম। উত্তরে বেলাল বলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমি কোনো গুনাহ করলেই দুই রাকাত নামাজ আদায় করি। আর অজু চলে গেলে তখনই অজু করে দুই রাকাত নামাজ আদায় করি। নবীজি (সা.) বলেন, এই দুই আমলের কারণেই তোমার এই মর্যাদা। [মুসনাদে আহমাদ : ২৩২৪]
দ্বিনের জন্য, ঈমান বাঁচানোর জন্য কতটুকু ত্যাগ করতে হবে—তার উৎকৃষ্ট উপমা বেলাল (রা.)।